শত প্রতিকূলতা আর দারিদ্র্যকে জয় করে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের ১৩তম ব্যাচে নিজের স্থান করে নিয়েছেন মাহবুব আলম। কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়াই নয়, বরং তার এই যাত্রাপথ সংগ্রাম, অধ্যবসায় আর পারিবারিক দায়িত্ব পালনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
জামালপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে মাহবুব বেড়ে ওঠা। দিনমজুর বাবার সামান্য রোজগার আর অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা ব্যয়ের ভারে নুয়ে পড়া সংসারে অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। ভালো পোশাক কিংবা পুষ্টিকর খাবার হয়তো সবসময় বিলাসিতা , তবে মাহবুবের মনে শিক্ষার আলো জ্বালানোর প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল সবসময়। গ্রামের বিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারের টুকিটাকি কাজেও হাত লাগাতে হতো তাকে। অনেকের কাছে যখন স্কুল পালানো বা অলস সময় কাটানো স্বাভাবিক ঘটনা, তখন মাহাবুব স্বপ্ন দেখতেন উচ্চশিক্ষার, একটি সুন্দর ভবিষ্যতের।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি নেওয়াটা মাহবুবের জন্য সহজ ছিল না। ভালো মানের কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়ার আর্থিক সামর্থ্য তার পরিবারের ছিল না। তার এডমিশনের পুরো সময়টাই জীবনের বড় যুদ্ধক্ষেত্র ছিলো। ঐ পুরনো পাঠ্যবই আর স্বল্প সুযোগের মাঝেও মাহবুব নিজের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত জেগে তিনি পড়েছেন। অর্থের অভাবে প্রয়োজনীয় বইপত্র কিনতে না পারলেও বন্ধুদের কাছ থেকে চেয়ে এনে অথবা লাইব্রেরিতে বসেই তিনি নিজের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন।
মাহবুব জানান, “আমার মনে আছে, যখন ভর্তির ফরম পূরণের সময় আসে, তখন বাবার কাছেও পর্যাপ্ত টাকা ছিল না। মায়ের সামান্য জমানো কিছু টাকা আর ধারদেনা করে আমি ফরম পূরণ করি। সেই সময় মনে একটা ভয় কাজ করত, যদি সুযোগ না পাই তাহলে এই কষ্টের কোনো মানে থাকবে না।”
তবে মাহবুবরে জীবনে শুধু আর্থিক কষ্টের চিত্রই ছিল না। তার পরিবারের, বিশেষ করে তার মায়ের অনুপ্রেরণা ছিল তার সবচেয়ে বড় শক্তি। অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও মা সবসময় চাইতেন মাহাবুব যেন পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়। মায়ের সেই নীরব সমর্থন আর বাবার কঠোর পরিশ্রম মাহবুবকে আরও বেশি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলেছিল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার দিনগুলোতে মাহবুব একা ছিলেন না। তার এক বন্ধু তাকে পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে গিয়েছিল এবং পুরোটা সময় তার পাশে ছিল। নিজের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও বন্ধুর এই সাহায্য মাহবুব আজও কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেন। অবশেষে যখন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে তার ভর্তির সুযোগ হয়, তখন মাহবুবের চোখে আনন্দাশ্রু বাঁধ মানেনি। সেই মুহূর্তটি শুধু তার একার নয়, বরং তার পুরো পরিবারের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন ছিল।
আজ মাহবুব বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে হেঁটে বেড়ান একজন গর্বিত শিক্ষার্থী হিসেবে। তার এই পথচলা প্রমাণ করে, প্রবল ইচ্ছা আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে যেকোনো প্রতিকূলতা জয় করা সম্ভব। মাহবুবের গল্প সেইসব শিক্ষার্থীদের জন্য অনুপ্রেরণা, যারা অভাবের কারণে তাদের স্বপ্ন পূরণের সাহস হারিয়ে ফেলেন। তার জীবন আমাদের শেখায়, আর্থিক দৈন্যতা কখনোই মেধার বিকাশে বাধা হতে পারে না, যদি থাকে অদম্য শক্তি আর পরিবারের সমর্থন।