নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার স্বনামধন্য বিদ্যাপীঠ নাউতারা আবিউন্নেছা দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা নাসিরা আক্তারের বিরুদ্ধে এক দশক ধরে চলা অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ তুলে পরীক্ষা বর্জন করেছেন প্রতিষ্ঠানটির ১০ জন শিক্ষক ও কর্মচারীগণ। তারা অভিযোগ করেন, প্রধান শিক্ষিকা নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে গোপনে কমিটি গঠন, বিভিন্ন সরকারি ও উন্নয়ন ফান্ডের অর্থ আত্মসাৎসহ নানা অনিয়ম চালিয়ে যাচ্ছেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, দীর্ঘ ১০ বছর ধরে শিক্ষক-কর্মচারীদের কোনো প্রকার সম্পৃক্ততা বা অনুমতি ছাড়াই প্রধান শিক্ষিকা এককভাবে বিদ্যালয় পরিচালনা করছেন। বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব চাওয়া হলেও তা গোপন রাখা হয়। এসব অভিযোগের ভিত্তিতে তারা সোমবার (২৩ জুন) ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ জমা দিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরেই বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ের হিসাব গোপন রাখা হচ্ছে। শিক্ষক-কর্মচারীরা জানতে চাইলেও তাদের দেওয়া হয় না কোনো তথ্য। উপরন্তু প্রধান শিক্ষিকা নিজের পছন্দের কয়েকজনকে নিয়ে একটি ‘মনগড়া কমিটি’ গঠন করে দপ্তর ও আর্থিক সকল কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, যা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
প্রধান শিক্ষক নাসিরা আক্তারের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগের পেছনে রয়েছে তার পারিবারিক প্রভাব। তিনি সাবেক ডিমলা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি তবিবুল ইসলামের শালকের স্ত্রী এবং নৌকা প্রতীকের সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও ভুয়া সার্টিফিকেটের দায়ে শিক্ষকতা থেকে চাকরিচ্যুত হওয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম লেনিনের স্ত্রী। এই প্রভাব খাটিয়েই তিনি শিক্ষক-কর্মচারীদের ভয়ভীতি দেখাতেন বলে অভিযোগকারীরা জানান। নাসিরা আক্তার স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন প্রভাবশালী উপজেলা নেত্রী হওয়ায় এবং বিদ্যালয়ের কাছেই তার বাড়ি হওয়ায় তিনি কাউকে পরোয়া করেন না বলেও অভিযোগ রয়েছে।
প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ফান্ডের টাকা আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে: সেশন ফি, টিউশন ফি, রেজিস্ট্রেশন ফি, এসএসসি পরীক্ষার ফরম পূরণ ফি, প্রবেশপত্র ফি, প্রশংসাপত্র ও সনদের টাকা, অধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষার ফি, বিদ্যালয়ের পুরোনো বই-খাতা বিক্রির টাকা, উপবৃত্তির ফরম বিতরণের টাকা, শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন।
অভিযোগপত্রে আরও বলেছেন, প্রধান শিক্ষক সুকৌশলে একটি মনগড়া কমিটির মাধ্যমে ভুয়া ভাউচার তৈরি করে এই বিশাল অঙ্কের অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। বর্তমানে বিদ্যালয়ে প্রায় ১২০০ ছাত্র-ছাত্রী অধ্যয়নরত। ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে ষষ্ঠ শ্রেণীতে প্রতিজন শিক্ষার্থীর সেশন ফি ৮০০ টাকা এবং সপ্তম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ৭০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এত বিশাল অঙ্কের আয় থাকা সত্ত্বেও গত দশ বছরে শিক্ষক-কর্মচারীদের টিউশন ফি বাবদ মাত্র ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়েছে। এমনকি এই টিউশন ফির সমস্ত টাকা প্রধান শিক্ষকের নিজস্ব তৈরি করা সভাপতির মাধ্যমে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে বলেও দাবি করা হচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যালয়ের ব্যাংক হিসাবে মাত্র ৩ লাখ ২৭ হাজার টাকা জমা রয়েছে, যেখানে শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রাপ্য টিউশন ফি বাবদই অনেক বেশি অর্থ থাকার কথা। শিক্ষক-কর্মচারীরা তাদের ন্যায্য টিউশন ফির টাকা চাইতে গেলে প্রধান শিক্ষক নানা অজুহাতে সময়ক্ষেপণ করেন এবং তাদের পাওনা পরিশোধে অস্বীকৃতি জানান।
নাসিরা আক্তারের বিরুদ্ধে কেবল আর্থিক অনিয়মই নয়, সরকারি বিধিমালা লঙ্ঘনেরও একাধিক গুরুতর অভিযোগ উঠেছে: সরকারি বিধি মোতাবেক সেশন ফির অন্তর্ভুক্ত স্কাউট ও ক্রীড়া ফি বাবদ প্রতিজন ১৩০ টাকা এবং ধর্মীয় ফি বাবদ প্রতিজন ১০০ টাকা নেওয়া হলেও এই টাকা সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ক্রীড়া শিক্ষক ও ধর্মীয় শিক্ষকের যৌথ অ্যাকাউন্টে রাখা হয়নি। বিগত পাঁচ বছর ধরে বিদ্যালয়টিতে কোনো বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়নি, যা শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা দিচ্ছে। সরকারি বিধি অনুসারে বর্তমানে একটি শাখায় ৫৫ জন শিক্ষার্থী থাকার কথা থাকলেও প্রধান শিক্ষক সরকারি কোনো নিয়ম মানছেন না। প্রতিটি শাখায় ১২০ থেকে ১৫০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি করেছেন, যা শ্রেণীকক্ষে সুষ্ঠু পাঠদান ব্যাহত করছে এবং শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান মারাত্মকভাবে অবনতি ঘটাচ্ছে। তিনি সরকারি রুটিন না মেনে নিজস্ব মনগড়া রুটিন অনুযায়ী ক্লাস পরিচালনা করছেন, যা বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক শৃঙ্খলার পরিপন্থী।
এ বিষয়ে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষিকা নাসিরা আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে শুরুতে তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তবে পরে তিনি তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, “সরকারি বিধি মোতাবেক সবকিছুই করা হচ্ছে। বিধির বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
অভিযোগের প্রেক্ষিতে ডিমলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরানুজ্জামান বলেন, “অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজার আমির বোরহানকে দায়িত্ব দিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।