হারিকেনের আলোয় সাহানার চোখ
বন্ধু বেলালের ছোট বোনের বিয়ে। বিয়ের এখনও পাঁচ দিন বাকি। তবুও আমি আর বেলাল একসাথে তার গ্রামের বাড়ি রওনা দিলাম।
বেলাল বলল,
— “বন্ধু, তুই গেলে সবার খুব ভালো লাগবে। বাড়ির সবাই তোকে দেখার জন্য অপেক্ষায় আছে।”
তার বাবা-মায়ের সঙ্গে মেসে থাকা অবস্থায় অনেক কথা হয়েছে, কিন্তু কখনো যাওয়া হয়নি। এই প্রথম বিয়ে উপলক্ষে যাওয়া।
রাস্তায় বৃষ্টির সম্ভাবনা। আকাশ ভারী। আমরা যেতে যেতে যখন সোনাইল গ্রামে পৌঁছালাম, তখন কাঁচা রাস্তা দেখে যেন ছোটবেলার সেই দিনগুলোর মুহূর্তে স্মৃতিচারণ হলো।
এখন আমাদের অঞ্চলে কাঁচা রাস্তা প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু এই গ্রামের কাদামাটি, জমে থাকা পানি দেখে যে এক অদ্ভুত ভালো লাগা জমলো।
বেলাল আগেই বলেছিল,
— “বন্ধু, রাস্তা কিন্তু খুব খারাপ, কাদামাটির রাস্তা। গ্রামে যেতে বর্ষাকালে একটু কষ্ট হয়।”
আমি কিছু বলিনি। মনে মনে ভেবেছি — গ্রামে মাটির মানুষ বাস করে। গ্রামে তো মাটির রাস্তা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। মাটির গন্ধই তো আসল গ্রাম। যদিও আমাদের গ্রামে মাটির রাস্তা নেই।
রাস্তার দুই পাশে মেহগনি, ইউক্যালিপ্টাস আর আকাশমণি গাছ। ছোট ছোট কাশবন।
রাস্তায় একটা ছোট ব্রিজ। ব্রিজটার দুই ধারে মাঝারি দুইটা পুকুর।
বেলাল বলল,
— “রাত হলে আমরা এই মোড়ের দোকানটায় বসে আড্ডা দিই। গ্রামের সবাই আসে রাতে গরম সহ্য না করতে পেরে। অনেক রাত পর্যন্ত একসাথে কাটায়। আমার বন্ধুরা ব্রিজে বসে গান গায়।”
বাড়ি পৌঁছে হাত-মুখ ধুয়ে গোসল সেরে খেলাম। তারপর ঘুম। বিকালে ঘুম থেকে উঠলাম। দুজনে ঘুরতে বের হলাম।
বাজারটা দারুণ। মানুষের মুখে সরল হাসি। বাজারের লোকজন বেলালকে জিজ্ঞেস করল,
— “এই ছেলেটা কে?”
বেলাল হেসে বলল,
— “আমার খুব কাছের বন্ধু। শহর থেকে এসেছে। একসাথে পড়াশোনা করি।”
আকাশে বৃষ্টির সম্ভাবনা দেখে বাজার থেকে বাড়ি ফিরতে লাগলাম।
বাজার থেকে ব্রিজটার কাছে আসতেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে, আমরা দোকানে আশ্রয় নিলাম।
ওখানেই এক মেয়ের সঙ্গে পরিচয়। মেয়েটার নাম সাহানা। সম্পর্কে বেলালের মামাতো বোন।
ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে ।
সাহানা টিউশনে গিয়েছিল, আসতে একটু সন্ধ্যা হয়েছে। বৃষ্টি শুরু হওয়ায় বাড়িতে পৌঁছাতে পারেনি, তাই সাইকেল নিয়ে দোকানে দাঁড়িয়েছে।
চেহারায় এক অপূর্ব সরলতা। মুখে মায়া।
সে লাজুক হেসে জিজ্ঞেস করল,
— “আপনি কি বেলাল ভাইয়ার বন্ধু?”
আমি হেসে বললাম,
— “হ্যাঁ, অনেক দিনের পুরোনো বন্ধু,
তবে আপনার গ্রামে নতুন বন্ধু।”
তারপর সাহানা বেলালের সাথে কিছু কথা বলল। বৃষ্টির দিন, সেই হারিকেনের আলোয় দোকানের পাশে বসে তার চোখের ভেজা চাহনি আর চুল থেকে পড়তে থাকা পানির ফোঁটা আমাকে এক অদ্ভুত মোহে জড়িয়ে দিল।
মনের অজান্তেই খুব ভালো লেগে গেল।
বৃষ্টি একটু কমে গেলে বেলাল সাহানাকে বাড়ি যেতে বলল। আমাকেও বলল,
— “চল বাড়ি চলে যাই।”
আমি বললাম,
— “না, থাকি এখানে কিছুক্ষণ।”
রাতের দিকে আবার বৃষ্টি নামল। হারিকেনের আলো তেলের অভাবে নিভে গেল। দুটো মোমবাতি জ্বালানো হলো। দোকানের পাশে বাঁশের খাটে আমরা বসে থাকলাম। ব্রিজের ওপর টুপটাপ বৃষ্টির শব্দ। দূরে মাঠের মধ্যে আমন ধানের সবুজ পাতায় বৃষ্টির ফোঁটা ঝরছে। রাতের আকাশে হালকা জ্যোৎস্না।
বিয়ের দিন সকালে বাড়িতে তুমুল উৎসব। বর আসলো পাশের গ্রাম আউলিয়াগঞ্জ থেকে।
সাহানা কে খুব সুন্দরী লাগছিলো।
আমি নিজেকে সংযত রাখতে না পেরে,
ইয়ার্কি করে বললাম — “অতি চমৎকার লাগে তোমাকে।” বলার পর কিছুটা লজ্জাও পেলাম ।
সাহানাকে দেখে মনে হচ্ছিল, কিছু একটা বলবে। কিন্তু বলতে পারছিল না। আমি ওর চোখের ভাষা বুঝে নিয়েছিলাম।
বাড়ির অন্যান্য অতিথি ও বরযাত্রীদের সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক হয় । বেলালের চাচি`মা মর্জিনা আমাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসা দিয়েছে এই কয়েক দিনে ।
বেলালের মা বেলালের থেকেও আমাকে বেশী ভালোবাসে যদিও আমি সেটা মোবাইলে কথা বলেই বুঝেছিলাম। উনার মতো মহিলা হয় না , এতো সহজ সরল! আর এতো ভালো আচরণ !
বিয়ের রাতে ব্রিজ পর্যন্ত বরযাত্রীদের সাথে আসলাম।
সাহানাও আমার সাথে আসলো।
সাহানা বলল,
— “আপনি অনেক পরিশ্রম করলেন আজকে।”
আমি বললাম,
— “বন্ধুর বোন তো নিজের বোন। নিজের বোনের বিয়েতে ভাই কি বসে থাকে?”
সাহানা নিরবে মাথা নাড়ল।
তারপর বলল,
— “আমাদের গ্রামটা আপনার কেমন লাগলো?”
আমি বললাম,
— “এতো সুন্দর গ্রাম আর মানুষ — ভুলবো না কোনোদিন।” হেসে বললাম, _”তোমাকেও
বেশ ভালো লেগেছে ।”
ওর চোখে মায়ার আলো দেখতে পেলাম।
বিয়ের দুই দিন পর যখন ফেরার সময় এলো, গ্রামের বাতাস, কাদামাটির রাস্তা, হারিকেনের আলো, আকাশমণি গাছ — সবকিছু যেন আলাদা করে ডাকছিল।
আমাকে বিদায় দেওয়ার জন্য সবার সাথে সাহানাও এসেছিল চায়ের দোকানটায়।
বেলালের মা , চাচিমার চোখে ছলছল
করতেছিল জল।
বিদায়ের সময় সাহানা শুধু বলল,
— “ভালো থাকবেন। ভাইয়ার সাথে আসেন।”
আমি হেসে বললাম,
— “তুমিও ভালো থাকো । হয়তো আবার কোনোদিন আসব। তোমার বিয়েতেও আসতে পারি, যদি নিমন্ত্রণ করো।”
সাহানা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকল, বিষণ্ন মনে।
আমরা রওনা দিলাম একটা অটো চার্জার গাড়িতে করে।
পিছনে তাকিয়ে দেখি, সাহানা এখনও চায়ের দোকানটার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।
সেদিন থেকে এই গল্পের পাতায় একটা অব্যক্ত স্মৃতি হয়ে রয়ে গেল।