মোঃ মিলন হক
শ্যামপুর গ্রামের পাশ দিয়ে অবিশ্রান্ত বারিধারায় বয়ে চলেছে ডোলনদী। বর্ষার মৌসুম ব্যতীত বাকি সারাবছর নদীর ঘাটে মানুষের চলাচল। নদীর ঘাটে বটগাছের নীচে ক্লান্ত মধ্যাহ্নে, বিকালে সবাই যায়। বটগাছের নীচে আছে সুজন মিয়ার চায়ের দোকান। ডোলনদীতে দেশীয় প্রজাতির নানান মাছ পাওয়া যায়। রাতের বেলায় নদীতে অনেকে মাছ ধরতে যায়।
গ্রামের যুবক হারুন মিয়া। তার নদীর পাড়ে আছে তিন বিঘা জমি ও বাড়ির পাশে আছে দুই বিঘা জমি। সে বিবাহিত পুরুষ। তার স্ত্রীর নাম আমিনা এবং একজন পাঁচ বছরের ছেলে আছে।
একদিন রাতে বর্ষাকালে অমাবস্যার তিথিতে, হারুন ও তার বউ ঘরে ছেলেকে একা রেখে নদীতে মাছ ধরতে যায়। নদীতে ঝড় সৃষ্টি হলে ঝড়ের কবলে পড়ে দুজনে মারা যায়।
হারুন মিয়ার ছেলে মতি তার ছোট ভাই বাবুলের কাছে বড় হয়। বাবুল মিয়ার এক ছেলে। বাবুল মিয়া প্রচণ্ড অর্থলোভী।
মতি এখন চব্বিশ বছরের একজন যুবক। মতি কে খাওন-দাওন দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বাবুল মিয়া। বাবুল মিয়া সব সম্পত্তি নিজের দখলে রাখে, মতি কে ভাগ দেয় না। মতি সম্পত্তির ভাগ চাইলে বাবুল মিয়া ধরে মার দেয়। মতি ও তার বন্ধু সুমন সারাদিন সুজন মিয়ার চায়ের দোকানে বসে, বটতলায় শুয়ে কাটায়।
সুমন কালুর ছেলে। সুমন বিবাহিত কিন্তু তার বউ তার কাছে থাকে না। তার শশুর বাড়িতে থাকে। সুমন বেশ কয়েকবার শশুর বাড়িতে বউ নিতে গেলেও বউ কিছুতেই আসতে চাইনা।
মতির পছন্দ হয় দশম শ্রেণী পড়ুয়া পারুলকে। পারুল স্কুলে গেলে মতি তার পিছনে পিছনে যায়। মতি পারুল কে “পারু” বলে ডাকে।
পারুলের বাবা, ভাই নেই। তার মা আছে। পারুল কে বিয়ে করতে চাই সৌদি প্রবাসী বারেক মিয়ার ছেলে তারেক। বারেক মিয়া পারুলের মা আছিয়া কে অনেক দিন থেকে তার ছেলের সঙ্গে বিয়ের জন্য কথা বলতেছে।
পারুল তার মাকে বলে, “মা আমি মতি ভাইকে বিয়ে করবো। মতি ভাইয়ের কাছে আমি আমার জীবনের সুখ খুঁজে পাবো। মতি ভাই আমাকে তোমার কাছ থেকে দূর করবে না। মতি ভাই তোমাকে মায়ের মতো ভালোবাসবে। আমি মতি ভাইয়ের বউ হতে চাই।”
মতির বিয়ে ঠিক হলো। সুমনের বউ মতির বিয়ে উপলক্ষ্যে ফিরে এসেছে। মতি বিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে হয়। বিয়ের পর তাদের দাম্পত্যজীবন বেশ সুখে যাচ্ছিল। মতি ও কাজ কর্মে মনোযোগ দেয়।
তার চাচা বাবুল মিয়ার কাছে যায় আবাদি জমি তিন বিঘা ফেরত নেওয়ার জন্য, কিন্তু বাবুল মিয়া কিছুতেই জমি ফেরত দিবে না।
মতি গ্রামের মেম্বার খাদেম মিয়ার কাছে যায়। খাদেম মিয়া বলেন, “রাতে তোমার জমির বিষয়ে বৈঠক হবে। কিছু লোকজন নিয়ে আসিও।”
মতি সুমন, বক্কর, তোফাজ্জল চাচা সহ গ্রামের বেশ কয়েক জন লোক নিয়ে যায়। বাবুল মিয়া বিচারে উপস্থিত হয় না। খাদেম মিয়া বিচারে বাবুল মিয়াকে উপস্থিত হওয়ার জন্য কুদ্দুস কে ডাকতে পাঠায়।
কুদ্দুস বাবুল মিয়ার বাড়িতে ডাকতে যাওয়ার পর বাবুল মিয়া বিচারে উপস্থিত হয় এবং দশ কাঠা জমি দিতে চাই তিন মাস পর।
মতির গ্রামে কোন কাজ পায় না। মতির শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। মতি পারুলের শারীরিক চাহিদা পূর্ণ করতে অপারগ হয়।
মতি বাড়িতে থাকা অবস্থায় সুমন তাদের বাড়িতে আসে। মতি বাড়িতে না থাকলে সুমন মাঝেমধ্যে আসে। সুমনের পছন্দ হয় পারুল কে।
একদিন দুপুরে সুমন ও মতি সুজনের দোকানে চা খেয়ে, মতি সুমনকে বলে, “চল ফুটবল খেলি বাচ্চাদের সাথে।” সুমন বলে, “তুই খেল। আমার বাড়িতে কাজ আছে। আমি বাড়ি গেলাম।”
সুমন মতির বাড়িতে এসে রুমে ঢুকে পারুল কে পিছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে। পারুল ও সুমন দুইজনে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়।
সুমন বাড়ি কথা বলে মতিকে বলে আশায়। মতির মন খেলায় কিছুতে বসে না। অস্থিরতা কাজ করতেছে ওর অন্তরে। মতি খেলা বাদ দিয়ে বাড়িতে আসে এবং জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে পায় পারুল ও সুমনের শারীরিক সম্পর্কের দৃশ্য।
এই দৃশ্য দেখার পর মতি বাড়ি থেকে দৌড়ে এসে নদীতে ঝাঁপ দেয়। সারা দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নদীতে ডুব দেয়। সন্ধ্যায় সুজন মতিকে নদী থেকে উঠায়।
সুজন বলে, “তুই কি পাগলা হয়েছিস? দুপুরের পর থেকে ডুব দিতেছিস।”
সুজন বলে, “ভাই, আমার সব সর্বনাশ হয়ে গেছে!”
সুজন বলে, “কেমন করে?”
মতি বলে, “ভাই কিছু কথা গোপন করতে হয়।”
এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
এরপর মতি সন্ধ্যায় বাড়িতে। পারুল বলে, “সারাদিন কোথায় ছিলে? ঘরে চাউল, ডাল নেই। যা ছিল তা দিয়ে এখন রান্না করেছি। সকালে কি খাবো?’
মতি বলে, “সকালের খাওন নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না।”
দুজনেই আঙিনায় একটা চৌকির উপর শুয়ে আছে। পারুলের মাথা মতির বুকে আছে।
পারুল মতিকে বলে, “জ্যোৎস্নার আলোয় সব কিছু শুভ্র হয়ে উঠে। আমাদের জীবনের পাপ গুলোও যদি শুভ্র হয়ে যেত!”
এই কথা শোনার পর, মতির বুকে বিরহের আগুন লেগে যায়। মতি যেনো নিস্তব্ধ পাথরের মূর্তি হয়ে গেছে।
পারুল বলে, “তুমি কেনো জানি আজকে কিছু বলতেছো না?” মতি, নিস্তব্ধ! পারুল অভিমান করে তার মাথা মতির বুক থেকে সরিয়ে নেয়।
মতি কিছুক্ষণ পরে বলে, “আমি ভাবতেছি যাকে সৃষ্টিকর্তার পরে বিশ্বাস করি। যে ছাড়া আমার এই পৃথিবীতে আপন কেউ নেই। সে যদি নিজের সুখের জন্য আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, আমি কেন পাবো না? তাকে ছেড়ে থাকতে।”
পারুল বলে, “আমি তোমার কথার কিছু বুঝি না।” তখন মতি বলে,”গ্রামে থেকে আমি কি করবো? ঘরে চাউল, ডাল নেই। কালকে কুদ্দুস ভাই, তোফাজ্জল চাচা, বেলাল ভাই ইটভাটার কাজে শহরে যাবেন । আমিও তাদের সাথে যেতে চাই।”
পরদিন সকালে পারুল মতিকে বিদায় দেওয়ার সময় কান্না করে। মতি পারুল কে বলে, “কান্না করিও না। আমি আমার সব কিছু তোমাকে দিয়ে গেলাম। এই নীল আকাশ, এই মাটি, এই বাতাস, এই বৃষ্টি, আমার ঘর। যদি কখনো দুঃখ পাও, তোমাকে আনন্দ দিবে নীল আকাশ। যদি আমার কথা শুনতে চাও, বাতাসে কান পেতে দিও। যদি তোমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে, বৃষ্টি তার ফোঁটায় আমার জন্য গড়িয়ে পড়া জল মিশিয়ে নিবে।”
শহরে গিয়ে মতি তাদের সাথে ইটভাটায় কাজ না করে, একটা সুতার ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করে।
এদিকে সুমন পারুলকে একা পেয়ে তার ঘরে সারাক্ষণ থাকে।
অপরদিকে তারেক সৌদি থেকে বাসায় ফিরে এসে, মতির বাড়িতে গিয়ে পারুল কে হত্যার ভয় দেখায় ও গালিগালাজ করে আসে।
পারুল তারেক কে বড় ছুরি দেখিয়ে ভয় দেখায় এবং তারেক দৌড়ে পালায়।
সন্ধ্যায় পারুল ঘরে শুয়ে ছিল। মতি এসে পারুল কে জড়িয়ে ধরে এবং বালিশ চাপা দিয়ে মেরে দেয়। পারুলের লাশ বাড়ির পাশে আম গাছে ঝুলিয়ে দেয়। এবং মতি আবার শহরে ফিরে যায়।
মতিকে কেউ বাড়িতে আসতে দেখেনি।
সুমন রাতে পারুলের কাছে যায় এবং দেখে ঘরে পারুল নাই। পারুল কে দেখতে পায় গাছে সাথে ঝুলানো অবস্থায়। সুমন দৌড়ে পালায়।
পরদিন সকালে হোসনেরা বেগম কচু পাতার শাক খোঁজার জন্য গিয়ে দেখে, পারুলের গলায় ফাঁস। চিৎকার করে সবাই একত্রে হয় এবং পুলিশ কে লাশ ময়না তদন্তের জন্য খবর দেওয়া হয়। পুলিশ এসে জানতে পারে গতকাল দুপুরে তারেক পারুলকে হত্যার ভয় দেখায় এবং তারেক খুন করেছে— অনেকের জবানবন্দিতে পুলিশ তারেক কে ধরে নিয়ে যায়।
মতি কে পারুলের মৃত্যুর খবর দেয়। মতি গ্রামে আসে। মতি কান্নার ভান করে। পারুলের লাশ পুলিশ ময়না তদন্ত করতে নিয়ে যায়। পরদিন সকালে মাটি হয় পারুলের।
সুমন রাতে ভাত খাওনের পর তার বউকে বলে, “ঘরে চিনি আছে? চা খাওন লাগতো।”
তার বউ বলে, “নেই।”সুমন চিনি কেনার জন্য সুজনের দোকানে যায়। সুজনের দোকানে বন্ধ।
মতি কে দোকানে বসে থাকতে দেখতে পায়।
মতির কাছে সুমন আসে এবং বলে, “পারুল কে ঐ সালা তারেক মেরেছে।”
মতি বলে, “চল ঐ দিকে একটু হাঁটি দুজনে।”
নদীতে একটা ছোট নৌকা ছিল। নৌকায় দুজনে উঠে এবং মতি নিশ্চুপ ছিল। মতি সুমনের পিছন দিক থেকে ধরে নৌকার খুঁটির সাথে সুমনের গলা দড়ি দিয়ে বেঁধে চেপে ধরে। সুমন ওখানে মারা যায়।
মতি সুমনকে মেরে সারারাত বটগাছের উপর শুয়ে থাকে। ফজরের আগে আগে ঘুম থেকে ওঠে তার রুমে আসে।
পরদিন সকালে সুমনের লাশ পুলিশ ময়না তদন্তের জন্য নিয়ে যায়।
মতি বটগাছের ছায়ায় দুই হাঁটু গেড়ে বসে চিৎকার করে উঠে।