‘মানুষ’‘ এই শব্দটি যেন এক বিস্ময়, আবার এক দীর্ঘশ্বাস!! লক্ষ লক্ষ বছরের ইতিহাস- সভ্যতার সূচনালগ্নেই মানুষ একে অপরের রক্তে হাত রাঙিয়েছে। এক সময়ের লোমশ, পাথরধারী আদিম মানুষ তার অস্তিত্ব রক্ষায় হত্যা করেছে। তা যেন প্রকৃতিরই নিয়ম ছিল। কিন্তু সময় পেরিয়ে, ভাষা এলো, নীতি এলো, ধর্ম এলো, শিল্প এলো, সভ্যতা এল- তবু রক্ত ঝরার রীতি গেল না। কেবল তার রূপ বদলেছে, জায়গা বদলেছে, কিন্তু মৃত্যু ও হিংস্রতার কাহিনি বদলায়নি।
একটা সময় ছিল, যখন হত্যা ছিল বেঁচে থাকার অপরিহার্য অঙ্গ তা মানুষের সাথে অথবা অন্য প্রানীকুলের সাথে। এখন, আধুনিক মানুষের হাতে মোবাইল, কম্পিউটার, স্যাটালাইট, এআই আর মুখে আদর্শ, ঘরে আলো তবু- মন অন্ধকারে। সেই মানুষই আরেক মানুষকে মেরে ফেলে, রাস্তায় ফেলে রাখে, চাঁদা না পেয়ে পাথরের ঘায়ে হত্যা করে। যেন সে কোনো কিছুর মূল্যই রাখে না আর। মানুষ যখন মানুষকে পাথর দিয়ে আঘাত করে, তখন তা শুধু এক দেহের মৃত্যু নয়, তা মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু।
পৃথিবীতে অগণন প্রাণী বাস করে, কিন্তু মানুষ একমাত্র প্রানী, যে নিজের জাতকেই নিয়মিত হত্যা করে। বাঘ মারে শিকারের প্রয়োজনে, সিংহ মারে পেটের দায়ে, কিন্তু তারা হত্যা করে না। অথচ- মানুষ মারে হিংসায়, লোভে, ক্রোধে, খামখেয়ালিতে, অভ্যাসে। সে মারে মুচকি হেসে, সে মারে চোখ বুজে, সে মারে ধর্মের নামে, রাজনীতির নামে, কিংবা নিছক বিরক্তিতে অথবা বেহুদাই। যে হৃদয়ে ভালোবাসা জন্ম নিতে পারত, সেই হৃদয় আজ বিদ্বেষের আগুনে জ্বলছে কারণ ছাড়াই।
আজ যদি অন্য কোনো প্রাণী আমাদের দিকে তাকায়, তার চোখে বিস্ময় থাকবে না, থাকবে করুণা। একটা পাখি হয়তো গাছের ডালে বসে দেখছে মানুষ মানুষের গলা কেটে ফেলছে, রাস্তায় পাথর দিয়ে মারছে , আর পাখিটি মনে মনে ভাবছে- আমরা তো তোমাদের তুলনায় নগণ্য প্রাণ, তবু আমাদের জাতকে তো আমরা কখনো মারি না!
একটা হরিণ হয়তো কান্না চেপে ভাবছে, “আমার তো শত্রু শুধু বাঘ; তোমাদের শত্রু তো তোমরাই!” এমনকি এক কুকুরও তার মালিকের পাশে বসে থাকলেও এখন ভয় পায়-কারণ সেই মানুষটাই একদিন তাকে বিষ খাইয়ে দিতে পারে। কী নির্মম ভাবনা ভাবতে বাধ্য হয়।
সবচেয়ে নির্মম সত্য হলো, আমরা এইসব দেখে অভ্যস্ত হয়ে গেছি এই দেশে। আজ আর মানুষ মরে গেলে কাঁপে না ভিতর। পাথর পড়লে কেবল হাড় ভাঙে না, ভাঙে একটা সমাজ, ভাঙে বিশ্বাস, ভাঙে এই বাঙালীর বাঙালিয়ানার অস্তিত্ব। তবু আমরা নির্বিকার হই, প্রতিদিন নতুন করে ভুলে যাই, আবার মানুষকেই মানুষ মারার সুযোগ করে দিই।
আমরা হয়তো অনেক উন্নত হয়েছি, কিন্তু হৃদয়ে আমরা এখনও সেই লোমশ, আদিম মানুষই রয়ে গেছি। শুধু মাথার শিংটা এখন অদৃশ্য, পাথরটা আধুনিক হয়ে গেছে। কখনও সেটা বুলেট, কখনো চাপাতি, কখনো পাথর, কখনও শব্দের বিষ, কখনও বিচারহীনতা।
তবু কেউ কেউ এখনও মানুষকে ভালোবাসে, এখনও চোখ ভিজে যায় কারও রক্তাক্ত নিথর দেহ দেখে। কেউ কেউ এখনো চুপ করে কাঁদে, রাতের আন্ধারে মানুষের জন্য মানুষ হয়েও।
কেননা যারা সত্যিকারের মানুষ, তাদের হৃদয়ে এখনো ব্যথা হয়। তারা জানে, এই পৃথিবী একদিন বদলাবে,একদিন এই পৃথিবী বাউলের হবে। হয়তো তারা বেঁচে থাকবে না, তবু তারা স্বপ্ন দেখে- যে একদিন আর কোনো মানুষকে আরেক মানুষের হাতে মরতে হবে না।
সেই স্বপ্নের আগে, পৃথিবী হয়তো আরেকটু কাঁদবে, বাতাসে ভেসে বেড়াবে আর্তনাদের ধ্বনি। আর কিছু পাখি, কিছু বৃক্ষ, কিছু নিরীহ প্রাণী মানুষকে দেখবে এক অদ্ভুত চোখে—বিচার নয়, করুণায়।
কারণ তারা জানে, মানুষ এখনো মানুষ হতে পারেনি।
এই দেশ, কিন্তু তার আগে—
এই পৃথিবী আরও অনেক কান্না দেখবে, হিংস্রতা দেখবে।
আরও অনেক পাথর উড়বে বাতাসে, আরো স্নাইপার থাকবে গোপনে।
আরও অনেক আধুনিক মানুষের ছায়া মিলিয়ে যাবে আদিম মানুষের গুহার আঁধারে।