গাইবান্ধা প্রতিনিধিঃ-
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর গাইবান্ধায় ২৯ কোটি টাকার দুইটি ভবন নির্মাণ কাজে দেড় কোটি টাকা ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। সৈকত এন্টারপ্রাইজের নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নির্বাহী প্রকৌশলী বেলাল আহমেদ, সহকারী প্রকৌশলী আশিষ কুমার বসু রায় ও উপ-সহকারী প্রকৌশলী শিশির চন্দ্র দেবনাথকে ঘুষ দিয়ে কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন। কাগজপত্র অনুমোদনের জন্য (সিএস) বাবদ শতকরা সিক্স পার্সেন্ট হারে দেড় কোটি টাকা ঘুষ নেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সারাদেশের মতো গাইবান্ধায়ও সাধারণ ঠিকাদাররা সৈকত এন্টারপ্রাইজ ও বসুন্ধরা বিল্ডার্স এর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। সাধারণ ঠিকাদাররা তাদের কাছ থেকে টু পার্সেন্ট টাকায় কাজ কিনে করতে বাধ্য হন। নওগাঁর বসুন্ধরা বিল্ডার্স ও কুষ্টিয়ার এস ই এবং সৈকত এন্টার প্রাইজ বিগত কয়েক বছর থেকে সারাদেশের মতো গাইবান্ধা জেলার শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, এলজিইডিসহ বেশ কয়েকটি দপ্তরের টেন্ডারের মাধ্যমে বহুতল ভবন, রাস্তা পাকাকরন কাজ করে আসছে। কাজের বাস্তব অভিজ্ঞতার সনদ বেশি থাকায় চলমান কাজের পরিমাণ কম দেখিয়ে বিগত বছরগুলোতে ক্ষমতাসীনদের আশ্রয় নিয়ে বাগিয়ে নিতো হাজার হাজার কোটি টাকার কনস্ট্রাকশন কাজ। সেই কাজ গুলো গাইবান্ধার বড় বড় ঠিকাদারেরা শতকরা টু পার্সেন্ট হারে লাইসেন্স কস্ট ঘুষ দিয়ে ভবন নির্মাণের কাজ করছেন। ‘এস ই’ ও ‘সৈকত এন্টারপ্রাইজ’ এর প্রোপ্রাইটর মুকুল মিয়া। সৈকত তার ছেলের নাম। তিনি দীর্ঘদিন ধরে লন্ডনে বসবাস করছেন। তার স্ত্রী শাহেদা বেগম কখনও থাকেন ঢাকায় আবার কখনও কুষ্টিয়ায়।
সূত্র জানায়, মুকুল মিয়া লন্ডনে থাকলেও ঠিকাদারেরা যোগাযোগ করেন ওই কোম্পানীর ম্যানেজার জাকিরের সাথে। আর মুকুলের ব্যাংক ম্যান্ডেট পাওয়ারম্যান হলেন তার স্ত্রী শাহেদা বেগম। এছাড়া অঞ্চল ভিত্তিকও একজন করে ম্যানেজার নিয়োগ করা আছে। উত্তরাঞ্চলের দায়িত্বে আছেন রংপুরের ঠিকাদার মাহফুজুর রহমান ফাত্তা। তাকে সহযোগিতা করেন নির্বাহী প্রকৌশলীর আস্থাভাজন পাবনার ঠিকাদার কামাল হোসেন। বেলাল আহমেদ ও কামাল হোসেনের বাড়ি পাবনা শহরের গোপালপুর এলাকার রবিউল মার্কেট মহিলা কলেজের পাশে।
ঘুষ গ্রহণের কথা স্বীকার করে কামাল হোসেন, মাহফুজুর রহমান ফাত্তাসহ নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঠিকাদারেরা জানান, গাইবান্ধা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরে পিসি ও ঘুষ বাণিজ্য এখনও আগের মতোই চলছে। তারা স্বীকার করেন, নির্বাহী প্রকৌশলী বেলাল আহমেদ সিএস বাবদ নেন শতকরা সিক্স পার্সেন্ট, ফাস্ট বিল থেকে ফাইনাল বিল পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে ধাপে নেন থ্রি পার্সেন্ট হারে ঘুষ৷ সহকারী প্রকৌশলী আশিষ কুমার বসু রায় ও উপসহকারী প্রকৌশলী শিশির চন্দ্র দেবনাথ নেন বাকি টু পার্সেন্ট। এছাড়া টেন পার্সেন্ট টাকা লেস দিয়ে দরপত্র সাবমিট করা সহ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে টু পার্সেন্ট দিতে হয়। ভ্যাট আইডি ১৫ পার্সেন্ট খরচ সহ একটি কন্সট্রাকশন কাজে মোট ৩৮ পার্সেন্ট টাকা চলে যায়। সে কারণে কাজ কম হবে বা নি¤œমানের হবে এতে কোনো সন্দেহ নাই। তবে সাব ঠিকাদার কত পার্সেন্ট ইনকাম করবেন তা বোধগম্য নয়। এমন সিস্টেমে চলছে গাইবান্ধা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। সুত্র জানায়, সৈকত এন্টার প্রাইজের লাইসেন্সে গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুরের মহিপুর বাজার ডিগ্রি কলেজ ও ফুলছড়ি উপজেলার চন্দিয়া মহিলা কলেজের ৪তলা ভবন নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। এতে প্রতিটির ব্যায় ধরা হয় দুই কোটি চুয়াল্লিশ লাখ টাকা। কঞ্চিপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামীলীগ নেতা জিএম সোহেল পারভেজ নির্মাণ কাজ করছেন। আর গাইবান্ধা সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের ছয়তলা ভবন নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন শহরের মহুরী পাড়ার বাসিন্দা বিবি ট্রেডার্সের স্বত্তাধিকারী খান মোঃ আমির হোসেন সোহেল এবং বোনারপাড়া এমএ দাখিল মাদ্রাসার চারতলা ভবন নির্মাণ কাজ করছেন ব্রিজ রোডের ঠিকাদার সিয়াম স্টোর এর স্বত্তাধিকারী নজরুল ইসলামের ছেলে সিহাব। তিনি জানান, আমার লাইসেন্সের কাজগুলো দেখাশুনা ছেলে সিহাবই করে। সৈকত এন্টারপ্রাইজের কাছ থেকে কিনে বোনারপাড়া দাখিল মাদ্রাসার নির্মাণ কাজ করছে সিহাব। কাজও প্রায় শেষের দিকে। আবারও সাঘাটা টেকনিক্যাল কলেজের কাজ পাচ্ছে। আর রশিদ ট্রেডার্স পাচ্ছে গোবিন্দগঞ্জ টেশনিকেল কলেজ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এতো টাকা ইনভেষ্ট করে রশিদ ভাই ভুল করার লোক নয়। কোনো সমস্যা নাই। সিএসও ঢাকা চলে গেছে।
অনুসন্ধান বলছে, গোবিন্দগঞ্জ টেকনিক্যাল কলেজ ও সাঘাটা টেকনিক্যাল কলেজ নির্মাণে গত ৩ জুলাই দরপত্র আহবান করে ৩১ জুলাই ওপেনিং করে দপ্তরটি। গোবিন্দগঞ্জ টেকনিক্যাল কলেজের ইষ্টিমেট কস্ট ধরা হয়েছে ১৮ কোটি ৭৪ লাখ ৩০ হাজার এবং সাঘাটা টেকনিক্যাল কলেজ ১০ কোটি ২০ লাখ ১৮ হাজার ৩৩৫ টাকা ধরা হয়েছে। এই দুটি কাজে ২৮ কোটি ৯৪ লাখ ৪৮ হাজার মোট টাকার শতকরা সিক্স পার্সেন্ট টাকা হিসেবে দরকষাকষির ইতি ঘটে কয়েকদিন আগে। গোবিন্দগঞ্জ কলেজের নির্মাণ কাজ নির্বাহী প্রকৌশলীকে এক কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে কাজ কিনে নেন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মের্সাস রশিদ ট্রেডার্স। রশিদ ট্রেডার্সের মালিক আব্দুর রশিদ শহর আওয়ামীলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন। তিনি বর্তমানে বসুন্ধরা বিল্ডার্সের লাইসেন্সে গাইবান্ধা সরকারি মহিলা কলেজ নির্মাণ কাজ করছেন। সাঘাটা টেকনিকেল কলেজের সিএস পাশ করতে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছেন সিহাব। তিনি সৈকতের নামে বোনারপাড়া এম এ দাখিল মাদ্রাসারও নির্মাণ কাজ করছেন। সৈকত এন্টার প্রাইজের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র অনুমোদনের জন্য ঢাকায় প্রধান প্রকৌশলীর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে বলেও একটি দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে। এছাড়া গাইবান্ধা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ করছে বসুন্ধরা বিল্ডার্স।
ঠিকাদারদের দাবি, নতুন প্রজ্ঞাপন অনুসরন করে ই- টেন্ডার করা হলে সরকারের লাভ বেশি হবে। কারণ, তখন এনিলেস দরপত্রে শতকরা টুয়েন্টি পার্সেন্ট থেকে থার্টি পার্সেন্ট পর্যন্ত ঠিকাদারেরা ডাক তোলে।
এদিকে, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের চলমান কন্সট্রাকশন কাজেও বেরিয়ে আসছে অনিয়ম। কর্মকর্তাগণের পিসি দিতে গিয়ে ঠিকাদারেরা বাধ্য হন। বে সরকারি প্রতিষ্ঠানের মেরামত ও সংস্কার প্রকল্পের আওতায় গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার সৈয়দপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি সেমিপাকা ঘর ও একটি চারতলা ভবনের কাজ চলমান। দুটো কাজেরই মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই।
প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক আব্দুর রকিব অভিযোগ করেন ‘সেমি পাকা ঘরটির চালে ব্যবহৃত সিআইসিটে (ঢেউটিন) আবুল খায়ের স্ট্রীল এর” গরু মার্কা লাল রংয়ের সিলের মধ্য লেখা আছে ৪৬ এমএম সিআইসিট, লাগানো হয়েছে ৩০ এমএম। এছাড়া ঘর নির্মাণের সময়ও গাঁথুনিতে দুই তিন নম্বরের ইট সহ এখন মেঝের সলিংয়েও সেই ইট দিয়ে কাজ শুরু করলে কাজ বন্ধ করে দেই। যদি তাই না হবে ঠিকাদার চার মাসেও সিআইসিট পরিবর্তন করেননি। তবে গত ১৬ সেপ্টেম্বর উপ সহকারী প্রকৌশলী মেহেদী হাসান (ফুলছড়ি) স্বাক্ষরিত পত্রে দ্রুত অপসারণপূর্বক সিডিউল অনুযায়ী সিআইসিট স্থাপনসহ অবশিষ্ট সকল কাজ দ্রুত সম্পন্ন করতে মেসার্স আবদুল মান্নান ট্রেডার্সে কে বলা হয়েছে। অন্যথায় ঠিকাদারের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে মর্মে জানানো হয়।
প্রধান শিক্ষক আরো বলেন, চার তলা ভবনের কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে নিম্ন মানের সামগ্রী। বর্তমানে চলছে দরজার চৌকাঠ লাগানোর কাজ। সেখানে নিম্মমানের কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে।
‘সৈকত-বসুন্ধরার’ কাছে জিম্মি ঠিকাদাররা ২৯ কোটির ইষ্টিমেটে দেড়কোটি টাকা ঘুষ
-
নিজস্ব সংবাদ : - আপডেট সময় ০৯:২০:৩৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ অক্টোবর ২০২৫
- ৩ বার পড়া হয়েছে
ট্যাগস :
সর্বাধিক পঠিত


























